নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্ব শুরু হয়েছিল একটি নতুন আশার প্রতীক হিসেবে। কিন্তু সর্বশেষ একটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক সহায়তা অর্থপ্রদানকে কেন্দ্র করে তার সরকার এখন এক জটিল নৈতিক বিতর্কের মুখে পড়েছে।
যুক্তরাজ্য সরকারের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও) পরিচালিত ‘বাংলাদেশ – সংঘাত, জবাবদিহিতা ও শান্তিপূর্ণ রাজনীতি (বি-সিএপিপি)’ নামক একটি প্রকল্প ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকারকে কারিগরি সহায়তা ও শাসনব্যবস্থার উন্নয়নে সহায়তা করছে। ১৬ মার্চ যুক্তরাজ্য সরকার এক লাখ ৭৭ হাজার ২৩৩ পাউন্ড অর্থাৎ প্রায় ২ কোটি টাকার একটি অর্থ প্রদান করে কানাডাভিত্তিক উন্নয়ন পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান আলিনিয়া ইন্টারন্যাশনালকে। প্রতিষ্ঠানটি সরাসরি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়কে কারিগরি ও কৌশলগত সহায়তা দিচ্ছে।
কাগজে কলমে স্বাভাবিক মনে হলেও এই অর্থপ্রদানে উদ্বেগের কারণ—আলিনিয়ার সঙ্গে উইলিয়াম মরিসনের নাম জড়িত থাকার অভিযোগ। মরিসন হচ্ছেন সেই বিতর্কিত ব্যক্তিদের একজন, যিনি ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যের এক বড় সাহায্য কেলেঙ্কারিতে যুক্ত ছিলেন। তিনি তখন অ্যাডাম স্মিথ ইন্টারন্যাশনাল (এএসআই) নামক একটি বেসরকারি পরামর্শ প্রতিষ্ঠানে ছিলেন। অভিযোগ ছিল—যুক্তরাজ্য সরকারের গোপন নথি ব্যবহার করে তারা নিজেদের ব্যবসায়িক সুবিধা নিয়েছে। ব্যাপক গণমাধ্যম ও সংসদীয় চাপের মুখে মরিসনসহ চারজন শীর্ষ নির্বাহী পদত্যাগ করেন।
দ্য সান পত্রিকায় সে সময় প্রকাশিত একটি শিরোনাম ছিল: দরিদ্রদের ‘ব্যবসা’ করে যারা লাভ করেছে, সেই চার হোতা’ শেষমেশ পদত্যাগ করলেন।”
মরিসন পদত্যাগের আগে ১০ পাউন্ডের লাখের বেশি লভ্যাংশ পেয়েছিলেন। তার নাম হয়ে ওঠে সহায়তার নামে করপোরেট লোভের এক প্রতীকি ইঙ্গিত। এখন সেই আলিনিয়ার সঙ্গে ইউনূস সরকারের সম্পৃক্ততা এ নিয়ে বিব্রতকর প্রশ্ন তুলছে।
প্রশ্ন উঠেছে, মরিসনের সঙ্গে আলিনিয়ার সম্পৃক্ততা কি বাংলাদেশ সরকার বা ইউকে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রকাশ করা হয়েছিল?
এই ঠিকাদার নিয়োগে ইউনূস প্রশাসন কোনো যাচাই-বাছাই করেছে কি না?
বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পে স্বার্থসংঘাত এড়াতে কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে?
যুক্তরাজ্য সরকারের ডেভলপমেন্ট ট্র্যাকার অনুসারে, এ অর্থপ্রদান ছিল একটি বড় ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৪৬৮ পাউন্ডের চুক্তির অংশ , যার উদ্দেশ্য “প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সংস্কার ব্যবস্থাপনা ও কৌশলগত যোগাযোগ সক্ষমতা বৃদ্ধি।” এখানে “সরকারি বার্তা জোরদার ও বিভ্রান্তি প্রতিরোধ”–এর মতো ভাষা ব্যবহার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ বলেও সমালোচকরা মন্তব্য করছেন।
এ ঘটনা এমন এক সময় সামনে এলো, যখন ইউনুস প্রশাসন একাধিক চাপের মুখে। একদিকে ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক সমাজের আন্দোলন, অন্যদিকে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং সেনাবাহিনীর অস্বস্তির খবর—সব মিলিয়ে রাজনৈতিক বাস্তবতা বেশ জটিল।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সংকেত ইতিবাচক নয়। সম্প্রতি লন্ডন সফরে ইউনূসের সঙ্গে লেবার নেতা কিয়ার স্টারমারের সাক্ষাৎ না হওয়া রাজনৈতিক বার্তা হিসেবেই ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
উইলিয়াম মরিসন বর্তমানে একটি প্রতিষ্ঠান মেট্রিক্সলেড নিজেদেরকে ফাইভ আইস গোয়েন্দা অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করে বলে দাবি করে। যদিও শেখ হাসিনার হঠাৎ রাজনৈতিক পতনের পেছনে কোনো গোয়েন্দা ষড়যন্ত্রের প্রমাণ নেই, তবু মরিসনের মতো ব্যক্তির পুনরায় বাংলাদেশের দৃশ্যপটে আসা আলোচনার জন্ম দিচ্ছে।
লিঙ্কডইনে মরিসন একসময় নিজেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেও দাবি করেছিলেন—যা এখন মুছে ফেলা হয়েছে।
ড. ইউনুস তার জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছেন দরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়ন এবং নৈতিক উন্নয়ন মডেল তৈরিতে। কিন্তু একটি সরকারের নেতৃত্ব দেওয়া শুধু নৈতিক ভাবমূর্তি নয়—প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রমাণও প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউনূসের উচিত হবে দ্রুত ও স্বচ্ছভাবে আলিনিয়ার ভূমিকা এবং বিতর্কিত ব্যক্তিদের যেকোনো সংশ্লিষ্টতা প্রকাশ করা। নইলে তার সরকার একটি "পুরাতন কৌশলের নতুন মুখোশ" হিসেবে দেখা দেবে—যা তার দীর্ঘদিনের অর্জনকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।